প্রতিক্ষণ ডেস্ক
তারিখঃ ০৪.১০.১৯৭১
মাগো,
সবেমাত্র রণাঙ্গন থেকে ফিরে এসে শিবিরে বিশ্রাম নিচ্ছি। একটা বিস্তীর্ণ এলাকা শক্রমুক্ত করতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছি। মনটা তাই বেশ উৎফুল্ল। হঠাৎ মনে পড়ল তোমাকে। বাড়ি থেকে আসার পর এই প্রথম তোমাকে লিখছি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তোমায় লিখতে পারিনি। বাঙ্কারে বসে আছি। বাইরে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি আর বাতাসের শব্দ মিলে একটা চাপা আর্তনাদ ভেসে আসছে।
মাগো, আজ মনে পড়ছে বিদায় নেবার বেলায় তোমার করুণ হাসিমুখ। সাদা ধবধবে শাড়িটায় বেশ মানিয়েছিল তোমাকে। সেদিনের পূর্ব দিগন্তের সূর্যটা বেশ লাল মনে হয়েছিল। আমার কী মনে হয়েছিল জানো মা? অসংখ্য বাঙালির রক্তে রঞ্জিত ঐ লাল সূর্যটা, ওর প্রতিটা কিরণচ্ছটা পৃথিবীতে জন্ম দিয়েছে অগ্নি-শপথে বলীয়ান, স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত এক একটা বাঙালি সন্তান। মাগো-তোমার কোলে জন্মে আমি ধন্য। শহীদের রক্তরাঙ্গা পথে তোমার আদুরে ছেলেকে এগিয়ে দিয়েছে। ক্ষণিকের জন্যও তোমার বুক কাঁপেনি, স্নেহের বন্ধন-দেশমাতৃকার দাক উপেক্ষা করতে পারোনি। মা, তুমি শুনে খুশি হবে যে তোমারই মতো অসংখ্য জননী তাদের স্নেহ ও ভালোবাসায় ধন-পুত্র-স্বামী, আত্তিয়-সর্বস্ব হারিয়েও শোকে মুহ্যমান হয়নি; বরং ইস্পাতকঠিন মনোবল নিয়ে আজ অগ্নি-শপথে বলীয়ান।
মাগো- বাংলার প্রতিটি জননী কি তাঁদের ছেলেকে দেশের তরে দান করতে পারে না-পারে না মা-বোনেরা ভাইদের পাশে এসে দাঁড়াতে? তুমিই তো একদিন বলেছিলে। সেদিন বেশি দূরে নয়-যেদিন এ দেশের শিশুরা মা-বাবার কাছে বিস্কুট-চকলেট না চেয়ে চাইবে পিস্তল-রিভলবার।
সেদিনের আশায় পথ চেয়ে আছে বাংলার প্রতিটি সন্তান, যেদিন বাংলার স্বাধীনতার সূর্য প্রতিফলিত হবে, অধিকারবঞ্চিত, শোষিত, নিপীড়িত, বুভুক্ষু সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা। যে মনোবল নিয়ে প্রথম তোমা থেকে বিদায় নিয়েছিলাম, তা আজ শতগুণ বেড়ে গেছে। তাই তো বাংলার আনাচে কানাচে এক মহাশক্তিতে বলীয়ান তোমার অবুঝ শিশুগুলোই আজ হানাদার বাহিনীকে চরম আঘাত হেনেছে-পান করছে হানাদার পশুদের তাজা রক্ত। ওরা মানুষ হত্যা করছে-আর আমরা পশু হত্যা করছি।
মা, মাগো। দুটি পায়ে পড়ি মা। তোমার ছেলে ও মেয়েকে দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে ঘরে আটকে রেখো না। ছেড়ে দাও স্বাধীনতার উত্তপ্ত রক্তপথে। শহীদ হয়ে অমর হব, গাজী হয়ে তোমারই কোলে ফিরে আসব মা। মাগো, জয়ী আমরা হবই। দোয়া রেখো। জয়ী আমরা হবোই। জয় বাংলা।
তোমারই দুলাল।
চিঠি লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা দুলাল। তাঁর বিস্তারিত পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। ফুলবাড়িয়ার সম্মুখসমরে তিনি আহত হন এবং পরে মারা যান। আহত হওয়ার সময় চিঠিটি তাঁর পকেটে ছিল। এটি পরে মুক্তিযুদ্ধকালে প্রকাশিত ‘জাগ্রত বাংলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে পত্রিকাটি ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে প্রকাশিত হতো।
চিঠি প্রাপকঃ মা। তাঁর পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
চিঠিটি পাঠিয়েছেনঃ এস এ কালাম, সম্পাদক, সাপ্তাহিক চরকা ও ‘৭১ মুক্তিযুদ্ধে জাগ্রত বাংলা।
প্রতিক্ষণ/এডি/এফটি